বাংলা ভাষার উৎপত্তি ও তার ইতিহাস
বাংলা হ'ল বিশ্বের অন্যতম বহুল আলোচিত ভাষা। বাংলা হ'ল বাংলাদেশ এবং ভারতীয় রাজ্য ত্রিপুরা ও পশ্চিমবঙ্গে ব্যবহূত প্রধান ভাষা। বাংলা ভাষাকে পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে মিষ্টি ভাষা বলা হয়। বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। এখানে প্রায় ১৩ কোটি লোক এই ভাষা বলে।
ভাষা কি?
ব্যাকরণ এর সংজ্ঞা অনুযায়ী, ধ্বনি যন্ত্রের সাহায্যে উচ্চারিত ধ্বনিসমষ্টিকে যা দিয়ে আমরা মনের ভাব প্রকাশ করা হয় তাকেই ভাষা বলে। কিন্তু এটুকু বললেই ভাষা কি সেটা বোঝানো যায় না। ভাষা হচ্ছে একটি সজীব সংগঠন। ভাষা সজীব, কারণ মানুষ যেমন একটু একটু করে প্রতিদিন বাড়ছে ভাষা ও ঠিক তেমনই প্রতিদিন একটু একটু করে বাড়ছে। মানুষ বর্তমানে এখন যে বাংলা ভাষায় কথা বলে, ৫০ বছর আগে এই রকম বাংলা ভাষায় কেউ কথা বলতো না। বর্তমান সময়ে বাংলা ভাষায় কথা বলার সময় অনেক ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করে প্রত্যেকে। পূর্ববর্তী প্রজন্মে এমন বাংলা ভাষা ব্যবহার করা হতো যেটা এখনকার সময় বললে কেউ বুঝতেই পারবে না, যেমন "গবাক্ষ", গবাক্ষ শব্দটির অর্থ হল জানালা। কিন্তু বর্তমান সময়ে বাঙালি এতটাই অলস হয়ে পড়েছে যে তারা জানালা শব্দটাকে জানালা না বলে জানলা বলে।বাংলা ভাষার উদ্ভবের ইতিহাস:
আলাদা আলদা দুটি ভূখণ্ডের ভাষা যখন একরকম হয়ে যায় তখন, সেটাকে ভাষা বলা হয়না, তাকে বলা হয় ভাসাবংশ। আজ থেকে পাঁচ হাজার বছর আছে যে ভাষা বংশের ব্যাপারে আমরা জানতাম তার নাম ছিল "ইন্দো-ইউরোপীয়"। এই "ইন্দো-ইউরোপীয়" ভাষা বংশের পরিধি ছিল ভারত ও ইউরোপ পর্যন্ত। এখানে "ইন্দো" বলতে ভারত কে বোঝানো হয়েছে এবং "ইউরোপীয়" বলতে ইউরোপ দেশ কে বোঝানো হয়েছে। আজ থেকে পাঁচ লাখ বছর আগে ভারত, বাংলাদেশ ও তার সীমান্তবর্তী কিছু এলাকার ভাষার মিল ছিল এই জন্য এটাকে বলা হয় "ভাষাবংশ"। ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাবংশে ইন্দো একটি ভূখণ্ড ও ইউরোপীয় একটি ভূখণ্ড বিভক্ত হওয়াই এই ভাষাবংশ টিকে দুটি শাখাতে ভাগ করা হয়। একটি হচ্ছে "শতম" ও আরেকটি "কেন্তুম" ।ভারতের মধ্যে "শতম" শাখায় কথা বলা হতো এবং ইউরোপের মানুষেরা "কেন্তুম" শাখায় কথা বলতো। যখন ভারতবর্ষে "শতম" শাখায় কথা বলা হতো, তখন ভারত বর্ষ একটি দেশ ছিল না, ভারতবর্ষ তখন একটি উপমহাদেশ ছিল। ভারতে অনেকগুলি জাতি থাকায় তারা আলাদা আলাদা ভাষায় কথা বলতো। যেমন আরবের জাতিরা "আরবীয়" ভাষায়, মিশরীরা "মিশরীয়" ভাষায় কথা বলতো, যারা ইরানের ছিল তারা "ইরানীয় ভাষায় কথা বলতো, ভারতীয়রা কথা বলতো "ভারতীয়" ভাষায়। ভারত অনেকটা বড় ছিল। তখন অন্য একটা দিক থেকে, একটি জাতি আসলো যা ভারত কে শাসন করতে লাগলো । সে জাতির নাম "আর্য"। আর্যদের শাসন করা কালীন, ভারতীয় আর্য ভাষা শিখে নিল। তখন ভাষাটি হয়ে গেল "ভারতীয়আর্য" ভাষা। ভারতীয় আর্যভাষা টি ভারতে ভাষার একটি রূপ। তখন সবাই "ভারতীয়আর্য" ভাষার কথা বলতে শুরু করে দিল।
পরবর্তীতে কথা বলা এবং লেখা দুটো আলাদা হয়ে গেল। অঞ্চল ভিত্তিতে যে ভাষায় কথা বলা হত তাকে তাকে মুখের ভাষা বলা হয়, বইয়ের ভাষায় যাকে বলে "প্রাকৃত" ভাষা। মানুষ যে ভাষায় লিখিত অর্থাৎ লিখিত ভাষার নাম ছিল "সংস্কৃত"। মুখের ভাষা অর্থ প্রাকৃত ভাষা কে আবার দুই ভাগে ভাগ করা হলো গৌড় অঞ্চলের যে ভাষায় কথা বলা হত তাকে বলা হল "গৌড়ীয় প্রাকৃত" এবং মগধ নামে যে এলাকা ছিল তারা যে ভাষায় কথা বলতো সেটির নাম ছিল "মাগধী প্রাকৃত"। সুনীতিকুমারের মতে বাংলা ভাষা এসেছে "মাগধী প্রাকৃত" থেকে দশম শতাব্দীতে। "গৌড়ীয় প্রাকৃত" থেকে বাংলা ভাষায় এসেছে সপ্তম শতাব্দীতে, এটি বলেছেন ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ । বাংলা ব্যাকরণে সুনীতিকুমারের কথাকে কে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়।
সুনীতিকুমারের মতে "মাগধী প্রাকৃত" হোক বা মোহাম্মদ শহীদুল্লাহর মতে "গৌড়ীয় প্রাকৃত" একসময় এই ভাষাটি বিকৃতি হয়ে যায়। ভাষা যখন ব্যর্থ হয় তখন সেটাকে বলা হয় "অপভ্রংশ"। এই বিকৃতি ভাষা থেকে সরাসরি একটি ভাষার উৎপন্ন হয় "বঙ্গকামরূপী"। "বঙ্গকামরূপী" যেটি "অপভ্রংশের" একটি রূপ। এখান থেকে সরাসরি কিছু ভাষা তৈরি হয় তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বাংলা, এরমধ্যে আবার আছে অসমীয়া যেটা বর্তমানে আসামের ভাষা, আরো আছে উড়িয়া ভাষা যেটা উড়িষ্যাতে কথা বলা হয়।
বাংলা ভাষার উৎপত্তি, গল্পের সাহায্যে সহজে মনে রাখার উপায়:
কলকাতা থেকে ইশভা নামে একটি মেয়ে বাংলাদেশ বেড়াতে গিয়েছে তার মায়ের সাথে এবং সেখানে গিয়ে তার বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে খুবই ভাল লেগেছে। সে তার মা'র কাছে গিয়ে বলে, মাগো এই বঙ্গ আমার খুবই ভালো লেগেছে। এখানে সবাই বাংলা ভাষায় কথা বলে।বাংলা ভাষার উৎপত্তি সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন উত্তর:
- প্রশ্ন: বাংলা ভাষার উৎপত্তি হয়েছে কোন ভাষা বংশ থেকে?
- উত্তর: বাংলা ভাষার উৎপত্তি হয়েছে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাবংশ থেকে।
- প্রশ্ন: বাংলা ভাষা কোন শাখা থেকে এসেছে?
- উত্তর: বাংলা ভাষা শতম শাখা থেকে এসেছে।
- প্রশ্ন: বাংলা ভাষা শতম শাখার কোন ভাষা থেকে এসেছে?
- উত্তর: বাংলা ভাষা শতম শাখার ভারতীয় ভাষা থেকে এসেছে।
- প্রশ্ন: বাংলা ভাষা মূলত কোন ভাষা থেকে এসেছে?
- উত্তর: বাংলা ভাষা মূলত প্রাকৃত ভাষা থেকে এসেছে
- প্রশ্ন: বাংলা ভাষা প্রাকৃত ভাষার কি থেকে এসেছে?
- উত্তর: সুনীতিকুমারের মতে মাগধী প্রাকৃত থেকে এবং শহীদুল্লাহর মতে গৌড়ীয় প্রাকৃত থেকে।
- প্রশ্ন: বাংলা ভাষা অপভ্রংশের কোন ভাষা থেকে এসেছে?
- উত্তর: বাংলা ভাষা সরাসরি অপভ্রংশের কামরূপী ভাষা থেকে এসেছে।